বছরটি প্যারা ব্যাডমিন্টন এবং এনায়েতের

প্রকাশিত: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৮ পিএম
শেয়ার করুন:  
বছরটি প্যারা ব্যাডমিন্টন এবং এনায়েতের

স্পোর্টস ডেস্ক: ‘আমাকে আমার সফলতা দ্বারা বিচার করো না। ব্যর্থতা থেকে কতবার আমি ঘুরে দাঁড়িয়েছে তা দিয়ে আমাকে বিচার করো’-নেলসন ম্যান্ডেলার বিখ্যাত এ উক্তিটি ভীষণ পছন্দ এনায়েত উল্যা খানের। কাজ করলে, পরিশ্রম এবং চেষ্টা করলে সাফল্য আসবেই-কথাটি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন এবং এটিকে ব্রত মেনেই জীবনের প্রতিটি দিন-ক্ষণ, মাস-বছর পার করে চলেছেন এক সময়কার কোর্ট কাঁপানো শাটলার, জাতীয় দলের সাবেক কোচ এবং বর্তমানে বাংলাদেশ প্যারা ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের সফল সাধারণ সম্পাদক এনায়েত। ব্যর্থতাকে পাশ কাটিয়ে আরো একটি সফলতম, সোনায় মোড়ানো বছর পার করলেন এ শাটলার-কোচ। ২০২৩ সালটি সত্যিকারে অর্থেই সোনায় মোড়া বছর এনায়েতের। বছরটি প্যারা ব্যাডমিন্টনের এবং একই সঙ্গে এনায়েতেরও।

দেশের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন খেলোয়াড় (প্রতিবন্ধী) শাটলারদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন এনায়েত। শুরুটা সেই ২০১৫-১৬ সালে। এরপর ২০১৮ সালে প্যারা ব্যাডমিন্টনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা থেকে ২০২৩-অবধি অনেক কাজ করেছেন। কুঁড়ি থেকে একটি সংগঠনকে ফুলে পরিণত করেছেন। সেই ফুলের সৌরভ এখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশ থেকে দেশান্তরে এর সৌরভ আর গৌরবে বিমোহিত সকলে। অথচ প্যারা শাটলারদের নিয়ে শুরুটা অত সহজ ছিল না। অনেক বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছেন এনায়েত। ৩০/৪০ জন শাটলার নিয়ে প্যারা ব্যাডমিন্টন শুরু করা এনায়েতের শিষ্য সংখ্যা এখন দেড়শ ছাড়িয়ে গেছে। আগামী বছর ডাবল সেঞ্চুরির প্রত্যয় এ সংগঠকের।

২০২৩ সালের ক্রীড়াঙ্গনের সালতামামি শুরু হয়ে গেছে। ক্রিকেট, ফুটবলের পাশে যদি অন্য কোনো সফল ইভেন্টকে যুক্ত করতে হয় কিংবা সাফল্যের মানদণ্ডের কষ্ঠিপাথরে যাচাই করা হয়; সেখানে থাকবে প্যারা ব্যাডমিন্টন এবং অবশ্যই এনায়েত উল্যা খানের নাম। তার হাত ধরেই যে শেষ হতে চলা বছরটিতে স্মরণীয় সব সাফল্য বয়ে এনেছেন প্যারা শাটলাররা। শুরুটা গেল সেপ্টেম্বরে। ফক্সেস ইন্দোনেশিয়া ইন্টারন্যাশনাল প্যারা ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টে। ওই আসরে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে পদক জেতে কোনো প্যারা শাটলার। নাম তার ইয়ামিন হোসেন। ডাবলসে অংশ নিয়ে দেশকে প্রথম আন্তর্জাতিক পদকের স্বাদ পাইয়ে দেন ইয়ামিন। যে আসরে কোচের ভূমিকায় ছিলেন এনায়েত উল্যা খান।

সেপ্টেম্বরের সাফল্যেকে ছাড়িয়ে নভেম্বরে ইতিহাসে নাম লেখায় প্যারা ব্যাডমিন্টন। জাপান ইন্টারন্যাশনাল প্যারা ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট থেকে ডাবল পদক অর্জন করে বাংলাদেশ। এনায়েত উল্যা খানের দুই শিষ্য মোহাম্মদ আলী ইমাম ও জয়তু ধর জাপান থেকে জোড়া ব্রোঞ্জ জেতেন। এ-গ্রেড টুর্নামেন্ট জাপান ইন্টারন্যাশনালের সেমিফাইনালে ওঠার মধ্য দিয়ে ব্রোঞ্জ জেতেন তারা। দুজনই ভিন্ন প্রতিযোগীকে সঙ্গী করে দেশের জন্য সাফল্য বয়ে আনেন। ডাবলসে বাংলাদেশের আলী ইমামের সঙ্গী ছিলেন নিউজিল্যান্ডের ওয়াজতেক। কোয়ার্টার ফাইনালে ইমাম-ওয়াজতেক জুটি ভারতের শুভ্রজিৎ -দিনেশ জুটিকে সরাসরি ২১-১২ এবং ২১- ১৯ পয়েন্ট ব্যবধানে হারিয়ে সেমিফাইনালে জায়গা করে নেন। অপরদিকে বাংলাদেশের আরেক প্যারা শাটলার জয়তু ধরের সঙ্গী ছিলেন ভারতের মঞ্জুনাথ। জয়তু- মঞ্জু জুটি কোয়ার্টার ফাইনালে ক্যামেরুনের এমাগুই- ইতিয়েন্নি সঙ্গা জুটিকে সরাসরি ২১- ০৮ এবং ২১- ০৯ পয়েন্টের ব্যবধানে পরাজিত করে শেষ চারে জায়গা করে নেন।

জাপানে ইতিহাস করা সৃষ্টি করা এনায়েত এবং তার শিষ্যদের জাপানের মাটিতে ভিন্ন রকম এক সংবর্ধনা দেয়া হয়। যা প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া বাকি ৩৭ দেশের আর কোনো প্রতিযোগী-কোচদের দেয়া হয়নি। শুধু তাই নয়। বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূতের বাসভবনেও বিশেষ সংবর্ধনা পান এনায়েত। ঘটনাটি চলতি মাসের ৬ ডিসেম্বর। বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরের বাসভবনে এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে পদক জয়ী জয়তু, ইমাম ছাড়াও ইন্দোনেশিয়া থেকে পদক জেতা আরেক প্যারা শাটলার ইয়ামিনকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। শাটলারদের সৌজন্যে মধ্যাহ্নভোজেরও আয়োজন করেন জাপানের রাষ্ট্রদূত। নিজ বাসভবনে অতিথিদের সস্ত্রীক অভ্যর্থনা জানান কিমিনোরে।

এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিন প্যারা শাটলার ছাড়াও তাদের কোচ বাংলাদেশ প্যারা ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এবং এক সময়ের কোর্ট কাঁপানের শাটলার এনায়েত উল্যা খান উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ন্যাশনাল প্যারালিম্পিক কমিটি অব বাংলাদেশের (এনপিসি, বাংলাদেশ) মহাসচিব ইঞ্জিনিয়ার মাকসুদুর রহমান, প্যারা ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের দুই সহসভাপতি মোহাম্মদ আকতারুজ্জামান ও কাজী নজরুল ইসলাম, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) ডেপুটি ডিরেক্টর রাশিদুজ্জামান সেরনিয়াবত, প্যারা ব্যাডমিন্টনের সদস্য এবং জাতীয় নারী দলের তারকা শাটলার এলিনা সুলতানা, মিৎসুবিশির ডিরেক্টর লি মায়োঙ্গো, প্যারা শাটলার নয়ন অধিকারী, মোহাম্মদ নাসিমসহ অন্যরা।

অক্টোবরে চীন সফরে যাওয়াও প্যারা শাটলারদের বিরাট সাফল্যের অংশ। চীনের হাংজু শহরে অনুষ্ঠিত প্যারা এশিয়ান গেমসে অংশ নিতেই ১৬ অক্টোবর দুই প্যারা শাটলারসহ পুরো প্যারা স্পোর্টস টিম নিয়ে চীন সফর করেন এনায়েত। এশিয়ান গেমস থেকে বড় কোনো সাফল্য না পেলেও ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় এবং আরচাররা সেখানে দারুণ পারফর্ম করেন। প্রথমবার এশিয়ান গেমসে অংশ নিয়ে সকলের মন জয় করে নেয় প্যারা ব্যাডমিন্টন।

শিষ্যদের পাশাপাশি বছর শেষে নিজেই র‌্যাকেট হাতে কোর্টে নেমে পড়েন এনায়েত। গত ১৫ ডিসেম্বর কাতারে অনুষ্ঠিত ‘বিজয় দিবস ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট কাতার-২০২৩’- এর ডাবলসে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন এনায়েত। যেখানে তার জুটি ছিলেন এক সময়কার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন রাসেল কবির। ডাবলসের ফাইনালে এনায়েত-রাসেল জুটি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের রেফাজ-সিনহা জুটিতে হারিয়ে কাতারে শিরোপা উৎসবে মাতেন। গেল তিন আসরের চ্যাম্পিয়ন ছিল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস।

এনায়েত উল্যা খান যেন পরশ পাথর। যেখানেই তার ছোঁয়া পড়ছে, সেখান থেকেই আসছে সাফল্য। রচনা করছেন একের পর এক পদক জয়ের কীর্তিগাঁথা। হোক সেটা কোচের ভূমিকাতে কিংবা নিজে কোর্টে নেমে খেলোয়াড়ের ভূমিকায়। খেলোয়াড়ী জীবনে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে শুরু করে সামার ওপেন জয়, স্বাধীনতা কাপ চ্যাম্পিয়ন থেকে জাতীয় মিক্সড ডাবলসে সাফল্য। সেই ধারা অব্যাহত থাকে আন্তর্জাতিক অ্যারেনাতেও। সিঙ্গাপুর থেকে দেশের জন্য বয়ে আনেন ওয়ার্ল্ড এয়ারলাইনস টুর্নামেন্ট থেকে শিরোপা। সেটা একবার নয়’ দু’বার। ৪৬টি আন্তর্জাতিক আসরে অংশ নেয়া একমাত্র বাংলাদেশি শাটলার এনায়েত। ওয়ার্ল্ড র‌্যাংকিংয়ে ১৯১তম স্থানে থাকাও লাল-সবুজের শাটলারদের জন্য বিরাট সাফল্যের। এমন অনেক সাফল্যে মোড়ানো এক নাম এনায়েত উল্যা খান।

যে কোনো ক্রীড়া এবং ক্রীড়াবিদের এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে স্পন্সরের ভূমিকা অপরিসীম। প্যারা ব্যাডমিন্টনও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এখানে স্পন্সররা এগিয়ে আসছেন না। সাফল্যের বছরের কিছুটা আক্ষেপের সুর এনায়েত উল্যা খানের কণ্ঠে। তিনি জানান, ‘আমরা এক সময় শাটলার ছিলাম। স্পন্সরের সহযোগিতায় জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আসরগুলোতে খেলার সুযোগ পেয়েছি। দেশের জন্য সাফল্য বয়ে এনেছি। প্যারা ব্যাডমিন্টনও দারুণ একটা সম্ভাবনাময় ইভেন্ট। এখানে স্পন্সররা এগিয়ে আসলে খেলাটি আরো প্রসারিত হবে; অনেক প্যারা শাটলারের স্বপ্ন পূরণ হবে। তাদেরকে অন্যের দ্বারস্ত হয়ে জীবন কাটাতে হবে না। আমি স্পন্সরদের কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি এই খেলাটিকে এগিয়ে নিতে আপনার সহযোগিতার হাত বাড়ান।’

পরিশেষে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সফল ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, ন্যাশনাল প্যারালিম্পিক কমিটি অব বাংলাদেশ (এনপিসি, বাংলাদেশ) এবং এর মহাসচিব ইঞ্জিনিয়ার মাকুসুদুর রহমান, এনপিসির কার্যনির্বাহী কমিটি এবং প্যারা ব্যাডমিন্টন ফেডারেশন, খেলোয়াড়দের জন্যই এত সব সাফল্য এসেছে মন্তব্য এনায়েতের।

এইচ কে